এক জীবন্ত ইতিহাসের গল্প:
ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে কলকাতার অনেক দিনের পুরনো সঙ্গী দার্জিলিং।
এই ইতিহাসের পটভূমি দার্জিলিং ও কিছুটা কলকাতা হলেও সূত্রপাত কিন্তু আমাদের দেশে নয়, বরং সুদূর ব্রিটেনের Wales এর এক সমুদ্র সৈকতে। সাল টা ছিল ১৯৪৭, আমাদের স্বাধীনতার বছরের কোন একটা দিনে একজন ভদ্রলোক সমুদ্রের ধারে বালির উপরে বসে ভাবছিলেন নতুন গাড়ির কি নকশা করা যায় সেটা নিয়ে, ওই ভদ্রলোক ছিলেন Maurice Wilks, ব্রিটেনের বিখ্যাত রোভার গাড়ি কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর ও ডিজাইনার। ভাবতে ভাবতে হটাৎ কখন যে সামনের ভিজে বালিতে একটা গাড়ির স্কেচ এঁকে ফেলেছেন নিজেই বুঝতে পারেন নি। আঁকা গাড়িটা অনেকটা আমেরিকান জীপ গাড়ির মত দেখতে হলেও মনে মনে ওই গাড়িটাতে তিনি বসিয়ে দিয়েছিলেন ওনার রোভার কোম্পানির বানানো শক্তিশালী ইঞ্জিন। প্রথমে ওনি বানালেন এমন একটা গাড়ি যার স্টিয়ারিং ছিল একদম মাঝে! তারপর আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ওনার কল্পনা রূপ নিতে সময় লাগলো এক বছর। ১৯৪৮ সালে আমস্টারডাম শহরের এক মোটর শো তে আত্মপ্রকাশ করলো এক নতুন ধরনের গাড়ি যা কিনা যেকোনো রাস্তায় চলার উপযোগী, নাম টাও বেশ অন্যরকম "ল্যান্ড রোভার", আর আত্মপ্রকাশের সাথেই সাথেই মানুষের মন জয় করে নিল এই ল্যান্ড রোভার। সত্যিই যেকোনো রাস্তায় চলতে পারতো এই শক্তিশালী গাড়ি। গাড়ির রঙ রাখা হলো হালকা সবুজ। এই সবুজ রঙের কারণ হিসাবে অনেকে বলেন যে কিছুদিন আগেই শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ মিলিটারির কামানে ও ফাইটার প্লেনের এর ককপিটের জন্য বানানো অতিরিক্ত এই সবুজ রঙ রোভার কোম্পানি কিনে নেয়, তবে এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। গাড়িটি রাতারাতি এত জনপ্রিয়তা পায় যে রোভার কোম্পানি ক্রমশ প্রায় ৭০ টি দেশে এই গাড়ি রপ্তানি করতে শুরু করে।
যাইহোক আমরা এবার আমাদের দেশে ফিরে আসি। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে পতাকার রঙ পরিবর্তন হলেও মানুষের জীবন ধারাতে তখনও সেইভাবে বিরাট কোনো পরিবর্তন আসে নি। সরকারি, বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদে বসে সাহেবরা তখনও দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। জুট মিল থেকে চা বাগান সব জায়গাতেই সাহেবরা তাদের দাপট মোটামুটি ধরে রেখেছে। ঠিক এই সময় কলকাতার রোভার কোম্পানির শোরুমে এলো ল্যান্ড রোভার এর প্রথম মডেল "সিরিজ ১"। আসার সাথে সাথে কলকাতার গাড়ি প্রেমীদের মনে ধরলো আজকের SUV গাড়ির পূর্বপুরুষ এই ল্যান্ড রোভারকে। এই গাড়ির যেকোনো রাস্তায় চলার ক্ষমতা প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দার্জিলিঙের চা বাগানের মালিক ও ম্যানেজার সাহেবদের। কলকাতার শোরুম থেকে তারা গাড়ি নিয়ে গেলেন দার্জিলিঙের পাহাড়ে। খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মসৃণ গতিতে চলতে থাকলো ল্যান্ড রোভার। সুদূর ব্রিটেনে জন্মানো এই গাড়িকে দেখে মনে হতে থাকলো সত্যি যেনো এই পাহাড়ের জন্যই বানানো! ৫০ এর দশকে ধনী চা বাগান মালিকদের আভিজাত্যের পরিচয় হয়ে দাড়ালো ল্যান্ড রোভার। অনুমান করা হয় ১,০০০ এর বেশি ল্যান্ড রোভার বিলেত থেকে আমদানি করা হয় যার সিংহভাগ ব্যাবহৃত হতো দার্জিলিং ও সংলগ্ন পাহাড়ে, আর বাকি উত্তর পূর্ব ভারতে।
ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সময় কখনো একইরকম যায় না। ল্যান্ড রোভার এর ক্ষেত্রেও সেটাই হতে চলেছিল। যে ধনী চা বাগান মালিকরা একদিন ল্যান্ড রোভারকে কলকাতার শোরুম থেকে যত্ন করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ে, সেই চা বাগান মালিকরা ৬০ এর দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে তাদের নিজেদের দেশের পথ ধরতে শুরু করলো। পাহাড়ে কমে আসতে থাকলো ব্রিটিশ সাহেব দের সংখ্যা। দেশে যাওয়ার আগে ওইসব সাহেবরা নামমাত্র দামে তাদের সাধের ল্যান্ড রোভার গুলোকে বিক্রি করে দিতে থাকলো এ দেশীও মানুষদের কাছে। বলতে গেলে প্রায় রাতারাতি কৌলিন্য হারিয়ে ল্যান্ড রোভার গোটা দার্জিলিং জুড়ে সাধারণ মানুষের গাড়ি হিসাবে ব্যাবহৃত হতে থাকলো। পরবর্তী প্রায় তিন দশকে দার্জিলিঙের "ভাড়ার গাড়ি" হিসাবে পরিচিতি পেলো তিনশোর বেশি ল্যান্ড রোভার যা এক সময় ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
ইতিমধ্যে সময় অনেকটা এগিয়ে গেছে, ল্যান্ড রোভার কোম্পানি বিদেশের বাজারে এনেছে তাদের নতুন মডেল "Range Rover", ভারতীয় বাজারেও আসতে শুরু করেছে বেশ কিছু নতুন গাড়ি কোম্পানি তাদের নতুন সব মডেল নিয়ে। আর ইতিহাস বলে নতুন আসলে পুরনো কে তার জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, এটাও কালের নিয়ম, অতএব গোটা দার্জিলিঙের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো ল্যান্ড রোভারকে আবার পড়তে হলো এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে, কিন্তু কঠিন রাস্তায় চলার জন্য যার জন্ম সে কি এত সহজে রাস্তা ছেড়ে দেবে? না সে রাস্তা ছেড়ে দেয় নি। বেশ কিছু গাড়ি লোহার দরে বিক্রি হলেও গোটা ৪০ ল্যান্ড রোভার এখনও তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। দার্জিলিং জেলার মানেভাঞ্জন থেকে সন্দাকফুর রাস্তায় আজও বেঁচে আছে এই জীবন্ত ইতিহাস। ৩২ কিলোমিটারের এই পাথুরে রাস্তায় আজও ধুলো উড়িয়ে চলে ল্যান্ড রোভার তার গৌরবময় অতীতের সাথে। ল্যান্ড রোভার মালিকরা তাদের বাপ ঠাকুরদার কাছ থেকে পাওয়া গাড়ি গুলোকে আজও আগলে রাখেন, তাদের সংগঠন "সিঙ্গালিলা ল্যান্ড রোভার অ্যাসোসিয়েশন" পৃথিবীর একমাত্র গাড়ি মালিকদের সংগঠন যাদের কাছে এখনও ল্যান্ড রোভার এর প্রথম মডেল "সিরিজ ১" চলনযোগ্য অবস্থায় আছে। কিন্তু এই গাড়ির গুলোর ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই পাহাড়ি মানুষ গুলোর বলিরেখা যুক্ত মুখের ভেতরে বসানো ছোটো ছোটো চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যায়। এই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেক বাধা। প্রথম হলো যন্ত্রাংশের অভাব, দ্বিতীয় ও প্রধান বাধা হলো চারপাশের পরিবেশ দ্রুত বদলে যাওয়া। মানেভাঞ্জান থেকে সন্দাকফু পর্যন্ত ওই ৩২ কিলোমিটারের ভীষণ দুর্গম পাথুরে রাস্তা যা সাধারণ গাড়ির জন্য একসময় প্রায় অগম্য বলে মনে করা হতো সেই রাস্তার প্রায় অর্ধেকটা আজ মসৃণ কংক্রিটের, খুব সহজেই আজকাল দিনের SUV গাড়িগুলো পাওয়ার স্টিয়ারিং এর জাদুতে দ্রুত উঠে আসছে পাহাড়ি বাঁক দিয়ে। চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে চলা আধুনিক SUV গাড়ির ভিড়ে ১৯৪৮-১৯৫০ সালের ল্যান্ড রোভারকে যেনো মনে হয় ক্লান্ত পথিক, তাও ল্যান্ড রোভার মালিকরা পরম যত্নে এক টুকরো লাল কাপড় দিয়ে মুছতে থাকেন গাড়ির বন্নেট। দৃশ্যটা যেনো মনে করায় সত্যজিৎ রায়ের "অভিযান" সিনেমার সিংজিকে যার অসহায় দৃষ্টির সামনে দিয়ে পুরনো Chrysler কে কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সেইসময় সদ্য আগত আধুনিক অ্যাম্বাসাডর। রোজ সকালে মানেভাঞ্জান এর রাস্তায় সার বেঁধে যাত্রীর অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকা ল্যান্ড রোভারের হারিয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা, আর তার সাথে চিরতরে হারিয়ে যাবে ৭০ বছরেরও বেশি পুরনো এক ইতিহাসের দলিল।
ল্যান্ড রোভার ব্র্যান্ডের আদি মালিক রোভার কোম্পানির কাছ থেকে ১৯৯৪ সালে বি.এম.ডব্লিউ এবং তাদের কাছ থেকে ২০০৬ সালে ফোর্ড কোম্পানির কাছে মালিকানা হস্তান্তর হয়ে সব শেষে ২০০৮ সালে এই মালিকানা আসে আমাদের টাটা মোটরসের কাছে। এই ব্র্যান্ডের বর্তমান মালিক যেহেতু আমাদের দেশীও একটি কোম্পানি তাই এটা আশা করা কি খুব অন্যায় যে প্রযুক্তিগত সাহায্যে আবার নতুন ভাবে ফিরে আসবে কোনরকমে টিকে থাকা ওই গোটা ৪০ ল্যান্ড রোভার! আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা মনে হয় একটু বেশি করে চাওয়া, কারণ শুধু সচেতনতার ও সদিচ্ছার অভাবে এর আগেও হারিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান ইতিহাস, এর অন্যতম উদাহরণ কলকাতার নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান, আজ যেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বহুতল বাড়ি।
ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের হতে ১৯৫১ সালে রয়াল ওয়ারেন্ট পাওয়া ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীক এবং অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই ল্যান্ড রোভার আজ তার জীবনের একদম শেষ লগ্নে এসে পৌঁছেছে, আর কিছুদিন পর থেকে শুধু ইতিহাসের বইতে খুঁজে পাওয়া যাবে অসামান্য এই গাড়িকে। ৭০ বছরেরও বেশি ঘটনাবহুল কর্মময় জীবন কাটিয়েও ল্যান্ড রোভার আজও ছুটছে পাহাড়ি রাস্তাতে, চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের সবার একবার অন্তত দেখে আসা উচিত এই জীবন্ত ইতিহাসকে।
সাথে দেওয়া প্রতিটা ছবি আমার নিজের তোলা, যা এক অনবদ্য ইতিহাসকে বন্দী করার চেষ্টা মাত্র।
Photo and text credit: Joydeep Sarkar.
No comments:
Post a Comment